প্রবন্ধ

ঈমান সম্পর্কে অতি গুরুত্বপূর্ণ ১২০টি প্রশ্নোত্তর (পর্ব- ৬)

প্রবন্ধটি পড়া হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে যিনি পরম করুনাময়, অসীম দয়ালু।

মূল: শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন (রহ.) অনুবাদক: মুহাঃ আব্দুল্লাহ আল-কাফী ও আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী
প্রশ্নঃ (৬৮) যারা আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে মানব রচিত আইন দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে তাদের হুকুম কি?
উত্তরঃ আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে বলছি যে, আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত বিধান দিয়ে রাষ্ট্র চালানো বা বিচার-ফয়সালা করা তাওহীদে রুবূবীয়্যাতের অন্তর্ভুক্ত। কেননা তাতে আল্লাহর রুবূবীয়্যাত, পরিপূর্ণ রাজত্ব এবং পরিচালনা ক্ষমতার দাবী অনুযায়ী তাঁর হুকুম কার্যকর করার নামান্তর। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ
)اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ(

“তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের আলেম ও ধর্ম-যাজকদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে এবং মারইয়ামের পুত্র মাসীহকেও অথচ তাদের প্রতি শুধু এই আদেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা শুধুমাত্র এক মা’বূদের এবাদত করবে, যিনি ব্যতীত মা’বূদ হওয়ার যোগ্য কেউ নয়। তিনি তাদের অংশী স্থাপন করা হতে পবিত্র।” (সূরা তাওবাঃ ৩১) এখানে আল্লাহ তাআ’লা ইয়াহুদী-নাসারাদের ধর্ম-যাজকদেরকে রব হিসাবে নাম করণ করেছেন। কারণ তারাও আল্লাহর বিধানের মত বিধান রচনা করত। তাদের রচিত বিধানের অনুসারীদেরকে গোলাম বা বান্দা হিসাবে নাম দেয়া হয়েছে। কারণ তারা আল্লাহর বিধানের বিরোধীতা করে ঐ সব পাদ্রি ও আলেমদের কাছে নতি স্বীকার করত এবং তাদের অনুসরণ করত। আদী বিন হাতেম (রাঃ) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বললেন, তারা তো তাদের এবাদত করে না। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তারা হালালকে হারাম করে এবং হারামকে হালাল করে। আর সাধারণ লোকেরা তাদের অনুসরণ করে থাকে। এটার নামই এবাদত।

আপনি জেনে নিন, যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করে না; বরং অন্যের বিধান দ্বারা বিচার-ফায়সালা করতে চায়, তাদের ব্যাপারে কুরআনের আয়াতগুলো দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথম প্রকারের আয়াতে তাদেরকে ঈমানহীন (মুনাফেক) দ্বিতীয় প্রকারের আয়াতে কাফের, জালেম ও ফাসেক বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,

)أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا فَكَيْفَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ ثُمَّ جَاءُوكَ يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ إِنْ أَرَدْنَا إِلَّا إِحْسَانًا وَتَوْفِيقًا  أُوْلَئِكَ الَّذِينَ يَعْلَمُ اللَّهُ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُلْ لَهُمْ فِي أَنفُسِهِمْ قَوْلًا بَلِيغًا وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمْ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمًا فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا(

“আপনি কি তাদেরকে দেখেন নি, যারা দাবী করে যে, আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তারা সে সমস্ত বিষয়ের উপর ঈমান এনেছে। তারা বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য শয়তানের কাছে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়। আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেনঃ তোমরা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং তাঁর রাসূলের দিকে এসো তখন আপনি মুনাফেকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ আরোপিত হয়, তখন কেমন হবে? অতঃপর তারা আল্লাহর নামে কসম খেয়ে ফিরে আসবে যে, কল্যাণ ও সমঝোতা ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। এরা হল সে সমস্ত লোক, যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অবগত। অতএব, আপনি ওদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওদেরকে সদুপদেশ দিয়ে এমন কোন কথা বলুন, যা তাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাদের (রাসূলগণের) আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি আপনার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসূলও যদি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী, মেহেরবান রূপে পেত। অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবূল করে নিবে।” (সূরা নিসাঃ ৬০-৬৫)

এখানে আল্লাহ তাআ’লা ঈমানের দাবীদার মুনাফেকদের কয়েকটি বৈশিষ্ট তুলে ধরেছেনঃ

(১) মুনাফেকদের প্রথম বৈশিষ্ট হলো তারা তাগুতের নিকট বিচার-ফায়সালার জন্য গমণ করে থাকে। প্রত্যেক ঐ বিষয় বা ব্যক্তির নামই তাগুত, যে আল্লাহর বিধানের বিরোধীতা করে। সমস্ত বিচার-ফায়সালা এবং হুকুমের মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআ’লা। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

)أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ  (

“জেনে রাখ তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ করা। আল্লাহ বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক।” (সূরা আ’রাফঃ ৫৪)
(২) তাদেরকে আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয় এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দিকে আহবান করা হলে তারা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
(৩) তারা কোন বিপদে পড়লে অথবা তাদের কৃতকর্ম মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়ে গেলে শপথ করে বলে থাকে যে, সৎ উদ্দেশ্য এবং পরিস্থিতি শান্ত রাখা ব্যতীত আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। বর্তমানে যারা ইসলামের বিধান বাদ দিয়ে মানব রচিত বিধান দিয়ে রাষ্ট্র চালায়, তাদের কথাও একই রকম। তারা বলে, আমাদের উদ্দেশ্য হল যুগোপযোগী শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের উপকার সাধন করা।

আল্লাহ তাআ’লা উপরোক্ত চরিত্রের অধিকারী মুনাফেকদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, আল্লাহ তাআ’লা তাদের অন্তরের খবর জানেন এবং তাদেরকে নসীহত করার জন্য এবং কঠোর ভাষায় কথা বলার জন্য নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে আদেশ দিয়েছেন। রাসূল পাঠানোর উদ্দেশ্য হল, যাতে শুধুমাত্র তাঁদেরই অনুসরণ করা হয়। অন্য মানুষের অনুসরণ নয়। তাদের চিন্তাধারা ও মতবাদ যতই শক্তিশালী হোক না কেন। অতঃপর আল্লাহ তাআ’লা নিজের রুবূবীয়্যাতের শপথ করে তাঁর রাসূলকে বলছেন যে, তিনটি বিষয়ের সমন্বয় ব্যতীত কারও ঈমান সংশোধন হবে না।

১)      সকল প্রকার বিরোধপূর্ণ বিষয়ে রাসূলের দিকে ফিরে আসা।
২)      রাসূলের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার জন্য অন্তরকে প্রশস্ত করা।
৩)      পরিপূর্ণভাবে রাসূলের ফায়সালাকে মেনে নেয়া এবং কোন প্রকার শীথিলতা ব্যতীত তা বাস্তবে রূপদান করা।

দ্বিতীয় প্রকারের আয়াত সমূহে আল্লাহ বলেন,

)وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الْكَافِرُونَ(

“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা কাফের।” (সূরা মায়েদাঃ ৪৪)

)وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الظَّالِمُونَ(

“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা জালেম।” (সূরা মায়েদাঃ ৪৫)

)وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الفَاسِقُوْنَ(

“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা ফাসেক।” (সূরা মায়েদাঃ ৪৭) যারা আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করে না তাদেরকে আল্লাহ উপরের তিনিটি আয়াতে পরপর কাফের, জালেম এবং ফাসেক বলেছেন। তিনটি গুণই কি এক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে? অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করল না, সে কাফের, ফাসেক এবং জালেমও বটে। কেননা আল্লাহ কাফেরদেরকে জালেম এবং ফাসেক হিসাবেও বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ বলেন,

)وَالْكَافِرُونَ هُمْ الظَّالِمُونَ(

“বস্তুতঃ কাফেরেরাই প্রকৃত জালেম।” (সূরা বাকারাঃ ২৫৪) আল্লাহ বলেন,

)إِنَّهُمْ كَفَرُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَمَاتُوا وَهُمْ فَاسِقُون(

“তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরী করেছে এবং ফাসেক অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।” (সূরা তাওবাঃ ৮৪) প্রত্যেক কাফেরই কি জালেম এবং ফাসেক? নাকি আল্লাহর আইন দিয়ে ফায়সালা না করার কারণে বিভিন্ন প্রকার মানুষের উপর অবস্থাভেদে এ সমস্ত বিধান প্রযোজ্য হবে। দ্বিতীয় মতটি আমার নিকট গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার না করলে মানুষ কখনো কাফের হয়, কখনো জালেম হয় আবার অবস্থাভেদে কখনো ফাসেক হয়।

সুতরাং আমরা বলব যে, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ মনে করে এবং অন্য বিধানকে অধিক উপযোগী ও উপকারী মনে করে তার মাধ্যমে মানুষের বিচার-ফায়সালা করে, তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে কাফের হয়ে যাবে। এদের অন্তর্ভুক্ত ঐ সমস্ত লোক, যারা মানুষের জন্য পথ হিসাবে ইসলাম বিরোধী বিধান রচনা করে। তারা তাদের রচিত বিধানকে মানুষের জন্য অধিক উত্তম ও উপযোগী মনে করেই তৈরী করে থাকে। এ কথা স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞাত হওয়া যায় যে, মানুষ এক পথ ছেড়ে দিয়ে যখন অন্য পথে চলে, তখন এটা মনে করেই চলে যে, প্রথম পথের চেয়ে দ্বিতীয় পথটি উত্তম।

আর যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে অন্যের বিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করে এবং বিচার-ফায়সালা করে কিন্তু সে আল্লাহর বিধানকে অবজ্ঞা করে না এবং অন্য বিধানকে অধিক উপকারী এবং উপযোগীও মনে করে না বরং সে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার কিংবা প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য এরূপ করে থাকে, তাহলে কাফের হবে না বরং জালেম হিসাবে গণ্য হবে।

আর যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে অন্য বিধানের মাধ্যমে রাষ্টীয় বিচার-ফায়সালা করে কিন্তু সে আল্লাহর বিধানকে অবজ্ঞা করে না এবং অন্য বিধানকে অধিক উপকারী এবং উপযোগীও মনে করে না, বরং বিচার প্রার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে কিংবা ঘুষ গ্রহণের জন্য কিংবা অন্য কোন পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য এরূপ করে থাকে, তা হলে কাফের হবে না; বরং ফাসেক হিসাবে গণ্য হবে।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের আলেমদেরকে রব্ব (প্রভু) হিসাবে গ্রহণ করে, তারা দু’প্রকার।

(১) তারা জানে যে, তাদের গুরুরা আল্লাহর দ্বীন পরিবর্তন করে ফেলেছে। তারপরও তারা তাদের অনুসরণ করে এবং তাদের হালাল করা বস্তকে হালাল ও হারামকে হারাম হিসাবে বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে তাদের নেতাদের অন্ধ অনুসরণ করে থাকে। তারা ভাল করেই জানে যে, তাদের নেতারা রাসূলদের আনীত দ্বীনকে পরিবর্তন করে ফেলেছে। এটা নিঃসন্দেহে কুফরী। এটাকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল শির্ক হিসাবে ব্যক্ত করেছেন।

(২) তারা কেবলমাত্র হারামকে হালাল এবং হালালকে হারাম করার ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করে। তারা আল্লাহর নাফরমানীতে তাদের নেতাদের অনুসরণ করেছে। যেমনভাবে মুসলমানেরা হারাম জেনেও পাপকাজে লিপ্ত হয়ে থাকে। তাদের হুকুম অন্যান্য পাপীদের মতই।

প্রশ্নঃ (৬৯) গাইরুল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য পশু কুরবানী করার হুকুম কি? গাইরুল্লাহর নামে যবাই করা পশুর গোশত ভক্ষণ করা জায়েয আছে কি?
উত্তরঃ গাইরুল্লাহর নামে পশু যবাই করা বড় শির্কের অন্তর্ভুক্ত। কেননা যবাই করা একটি এবাদত। আল্লাহ তাআ’লা এ মর্মে আদেশ দিয়ে বলেনঃ

)فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ(

“আপনার প্রভুর জন্য নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন।” (সূরা কাউছারঃ ২)

)قُلْ إِنَّ صَلاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَاي وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ(

“আপনি বলুন! আমার নামায, আমার সমস্ত এবাদত, আমার জীবন এবং আমার মরণ সব কিছু সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্যে। তাঁর কোন শরীক নেই, আমি এর জন্যে আদিষ্ট হয়েছি, আর আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আমিই হলাম প্রথম।” (সূরা আনআ’মঃ ১৬২-১৬৩) সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্যে পশু যবাই করবে, চাই সে কোন ফেরেশতার উদ্দেশ্যে করুক বা নবী-রাসূলের উদ্দেশ্যে বা কোন অলী বা আলেমের উদ্দেশ্যে করুক, সবই শির্কে পরিণত হবে এবং এতে লিপ্ত ব্যক্তি মুশরিকে পরিণত হবে। সুতরাং মুসলিম ব্যক্তির উচিৎ এ ধরণের শির্কে লিপ্ত না হওয়া। আল্লাহ বলেনঃ

)إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ (

“নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করবে, আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম, আর এরূপ অত্যাচারীদের জন্যে কোন সাহায্যকারী হবে না।” (সূরা মায়িদাঃ ৭২)

গাইরুল্লাহর জন্যে যবাইকৃত পশুর গোশত খাওয়া হারাম। যেমন আল্লাহ বলেনঃ

)حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ(

“তোমাদের জন্যে মৃত, রক্ত, শুকরের মাংস, আল্লাহ ছাড়া অপরের নামে উৎসর্গকৃত পশু, গলাটিপে মারা পশু, প্রহারে মৃত পশু, উপর থেকে পতিত হয়ে মারা যাওয়া পশু, অন্য পশুর শিংয়ের আঘাতে মৃত পশু এবং হিংস্র জন্তুর ভক্ষণ করা পশুর গোশত খাওয়া হারাম করা হয়েছে। তবে যা তোমরা যবাই দ্বারা পবিত্র করেছ, তা হালাল। আর যে সমস্ত পশুকে পূজার বেদীর উপর বলি দেয়া হয়েছে, তাও তোমাদের জন্য হারাম।” (সূরা মায়িদাঃ ৩)

**গাইরুল্লাহ অর্থ আল্লাহ্‌ ব্যাতিত অন্য কারো নামে বা উদ্দেশ্য, যেমন দেব দেবী, পীর, বাবা, ফকির, জীন ইত্যাদি।

প্রশ্নঃ (৭০) আল্লাহ বা তাঁর রাসূল অথবা দ্বীন নিয়ে হাসি ঠাট্টা করার হুকুম কি?
উত্তরঃ এই কাজটি অর্থাৎ আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অথবা কুরআন অথবা দ্বীন নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা কুফরী। যদিও তা মানুষকে হাসানোর নিয়তে হয়ে থাকে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর যুগে এ রকম বিদ্রুপের ঘটনা ঘটেছিল। একদা মুনাফেকরা তাঁকে এবং সাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে বলল, আমরা এ সমস্ত লোকদের চেয়ে অধিক পেট পূজারী, অধিক মিথ্যুক এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে এদের চেয়ে অধিক ভীতু আর কাউকে দেখিনি। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেনঃ

)وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ(

“আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, উত্তরে তারা অবশ্যই বলবে যে, আমরা কেবল হাসি-তামাসা করছিলাম।” (সূরা তাওবাঃ ৬৫) নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর কাছে যখন অভিযোগ আসল, তখন তারা বলল, পথের ক্লান্তি দূর করার জন্য যে সমস্ত কথা-বার্তা বলা হয়, আমরা শুধু তেমন কিছু কথাই বলছিলাম। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে আল্লাহর বাণী শুনিয়ে দিলেন।

) قُلْ أَبِاللَّهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ(

“বলুন! তোমরা কি আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ এবং তাঁর রাসূলকে নিয়ে হাসি-তামাসা করছিলে? তোমরা এখন ওযর পেশ করো না। তোমরা তো ঈমান প্রকাশের পর কুফরী করেছো।” (সূরা তাওবাঃ ৬৫-৬৬) কাজেই আল্লাহ তাআ’লা, রিসালাত, অহী এবং দ্বীনের বিভিন্ন বিষয় অত্যন্ত পবিত্র। এগুলোর কোন একটি নিয়ে ঠাট্টা করা বৈধ নয়। যে এরূপ করবে, সে কাফের হয়ে যাবে। কারণ তার কাজটি আল্লাহ, তাঁর রাসূল, কিতাব এবং শরীয়তকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রমাণ বহন করে। যারা এ ধরণের কাজ করবে, তাদের উচিৎ আল্লাহর দরবারে তাওবা করে এবং ক্ষমা চেয়ে নিজেকে সংশোধন করা। তাদের উচিৎ আল্লাহর প্রতি ভয় ও সম্মান দিয়ে অন্তরকে পরিপূর্ণ করা।

প্রশ্নঃ (৭১) কবরবাসীর কাছে দু’আ করার বিধান কি?
উত্তরঃ দু’আ করা দু’প্রকারঃ

(১) এবাদতের মাধ্যমে দু’আ। যেমনঃ নামায, রোজা এবং অন্যান্য এবাদত। মানুষ যখন নামায আদায় করে কিংবা রোযা রাখে, তখন সে প্রভুর কাছে উক্ত এবাদতের মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহর আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চায়। আল্লাহর বাণী,

)وَقَالَ رَبُّكُمْ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِين(

“তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো। যারা অহংকার করতঃ আমার এবাদত হতে বিমুখ হবে, তারা অবশ্যই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (সূরা মুমিনঃ ৬০) আল্লাহ তাআ’লা দু’আকে এবাদত হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি এবাদতের কোন প্রকার আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্যে পেশ করবে, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে কাফেরে পরিণত হবে। সুতরাং কেউ যদি কোন বস্তকে আল্লাহর মত সম্মানিত ভেবে তার সামনে রুকূ করে অথবা সেজদা করে, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে কাফেরে পরিণত হবে। এ কারণেই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শির্কের দরজা বন্ধ করার জন্য পারস্পরিক সাক্ষাতের সময় কারো সামনে মাথা নত করতে নিষেধ করেছেন। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে জিজ্ঞাসা করা হল, কোন ব্যক্তি কি মুসলিম ভাইয়ের সাক্ষাতে মাথা নত করবে? উত্তরে তিনি তা করতে নিষেধ করেছেন। সালাম দেয়ার সময় অজ্ঞ লোকেরা যদি আপনার সামনে মাথা নত করে, তবে আপনার উপর আবশ্যক হল, তাদের কাছে বিষয়টি বর্ণনা করে দেয়া এবং তাকে নিষেধ করে দেয়া।

(২) কোন প্রয়োজনে কারো নিকট কিছু চাওয়া বা প্রার্থনা করা। এটি সকল ক্ষেত্রে শির্ক নয়।

প্রথমতঃ যার কাছে দু’আ করা হবে, সে যদি জীবিত হয়ে থাকে এবং প্রার্থিত বস্ত প্রদান করতে সক্ষম হয়ে থাকে, তাহলে শির্ক হবে না। যেমন আপনি কাউকে বললেন, আমাকে পানি পান করান, আমাকে দশটি টাকা দিন, ইত্যাদি। এ ধরণের কথা শির্ক নয়। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তোমাদেরকে যখন কেউ আহবান করে, তবে তোমরা তার আহবানে সাড়া দাও। আল্লাহ বলেন,

)وَإِذَا حَضَرَ الْقِسْمَةَ أُوْلُوا الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينُ فَارْزُقُوهُمْ مِنْهُ(

“সম্পদ বন্টনের সময় আত্মীয়, ইয়াতীম এবং মিসকীন উপস্থিত হলে, তাদেরকে তা থেকে রিযিক হিসেবে কিছু দান কর।” (সূরা নিসাঃ ৮) সুতরাং ফকীর যদি হাত বাড়ায় এবং বলে আমাকে কিছু দান করুন, তাহলে তা জায়েয হবে। যেহেতু আল্লাহ বলেছেনঃ “তোমরা তাদেরকে রিজিক রিযিক হিসেবে কিছু দাও।”

দ্বিতীয়তঃ যার কাছে দু’আ করা হল, সে যদি মৃত হয়, তাহলে শির্ক হবে এবং এতে লিপ্ত ব্যক্তি মুশরিকে পরিণত হবে।

বড়ই আফসোসের বিষয় যে, কিছু কিছু মুসলিম অধ্যষিত দেশে এমন অনেক মুসলমান রয়েছে, যারা বিশ্বাস করে যে, কবরে দাফনকৃত মাটির সাথে মিশে যাওয়া মৃত লোকটি উপকার বা অপকারের ক্ষমতা রাখে অথবা সন্তানহীনকে সন্তান দিতে সক্ষম। এটি বড় শির্কের অন্তর্ভুক্ত, যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এ ধরণের শির্ককে সমর্থন করা মদ্য পান, ব্যভিচার এবং অন্যান্য পাপ কাজ সমর্থন করার চেয়েও জঘণ্য। আল্লাহর কাছে দু’আ করি তিনি যেন মুসলমানদের অবস্থা সংশোধন করে দেন।

প্রশ্নঃ (৭২) কাউকে আল্লাহর ওলী ভেবে তার কাছে বিপদে উদ্ধার কামনা করার জন্য ফরিয়াদ করা কি? আল্লাহর ওলী হওয়ার সঠিক আলামত কি?
উত্তরঃ আল্লাহ তাআ’লা ওলী হওয়ার গুণাগুণ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ

)أَلا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ(

“মনে রেখো যে, আল্লাহর ওলীদের না কোন আশঙ্কা আছে, আর না তারা বিষন্ন হবে। তারা হচ্ছে সেই সব লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহকে ভয় করে চলে।” (সূরা ইউনুসঃ ৬২-৬৩) ঈমান এবং তাকওয়া আল্লাহর ওলী হওয়ার প্রধান আলামত। সুতরাং যে মুমিন হবে এবং আল্লাহকে ভয় করে চলবে, সেই আল্লাহর অলী বা বন্ধু। যারা আল্লাহর সাথে শির্ক করবে, তারা আল্লাহর বন্ধু নয়; বরং তারা আল্লাহর শত্রু। আলাহ বলেনঃ

)مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِلَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ اللَّهَ عَدُوٌّ لِلْكَافِرِينَ(

“যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর রাসূল, তাঁর ফেরেশতাগণের, জিবরীলের এবং মিকাঈলের শত্রু হয়, নিশ্চয়ই আল্লাহ এরূপ কাফেরদের শত্রু।” (সূরা বাকারাঃ ৯৮) সুতরাং যে কোন মুসলিম গাইরুলাহর কাছে দু’আ করবে অথবা গাইরুলাহর কাছে এমন বিষয়ে ফরিয়াদ করবে, যে বিষয়ে তার কোন ক্ষমতা নেই, সে কাফের-মুশরিকে পরিণত হবে। সে কখনই আল্লাহর ওলী হতে পারে না। যদিও সে তা দাবী করে থাকে। বরং তাওহীদ, ঈমান এবং তাকওয়া বিহীন তার এ দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা।

মুসলমান ভাইদের প্রতি আমার উপদেশ হল, তারা যেন ভন্ড ওলীদের মাধ্যমে প্রতারিত না হয় এবং সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব এবং ছহীহ হাদীছের দ্বারস্ত হয়। তবেই তাদের আশা-ভরসা একমাত্র আল্লাহর উপরই হবে এবং মানসিক প্রশান্তি ও স্থিরতা লাভ করবে। এতে ভন্ডদের হাত থেকে তাদের ধন্তসম্পদও হেফাজতে থাকবে। তেমনিভাবে আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাতকে আকঁড়ে ধরার মধ্যে রয়েছে তাদেরকে ধোকার পথ হতে দূরে রাখার ব্যবস্থা। যারা কখনো নিজেদেরকে সায়্যেদ আবার কখনো ওলী হিসাবে দাবী করে, আপনি যদি তাদেরকে নিয়ে চিন্তা করেন, তবে দেখতে পাবেন যে, তারা আল্লাহর ওলী বা সায়্যেদ হওয়ার গুণাগুণ হতে সম্পূর্ণ দূরে। প্রকৃত পক্ষে যিনি আল্লাহর ওলী হবেন, তিনি নিজেকে ওলী হিসাবে প্রকাশ করা থেকে দূরে থাকবেন। আপনি তাকে পরহেজগার মুমিন হিসাবে দেখতে পাবেন। তিনি প্রকাশ করবেন না। তিনি মানুষের মাঝে ওলী হিসাবে প্রকাশিত হন বা মানুষ তার দিকে ধাবিত হোক, কোনটাই পছন্দ করবেন না। কোন মানুষ যদি এতটুকু কামনা করে যে, লোকেরা তাকে সম্মান করুক, তার কাছে এসে ভীড় করুক, তাহলে এটা হবে তাকওয়া এবং ওলী হওয়ার পরিপন্থী। যে ব্যক্তি মূর্খদের সাথে ঝগড়া করার জন্য অথবা আলেমদের সাথে বিতর্ক করা কিংবা লোকদেরকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য ইলম অর্জন করবে, তার জন্য নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে কঠিন সতর্ক বাণী এসেছে। যারা নিজেদেরকে ওলী হিসাবে দাবী করে এবং মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে, তারা প্রকৃত ওলীর গুণাগুণ হতে অনেক দূরে।

মুসলমান ভাইদের প্রতি আমার নসীহত হল, তারা যেন এ সমস্ত ভন্ডদের থেকে সাবধান থাকেন এবং আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহর দিকে ফিরে এসে আল্লাহকেই একমাত্র আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল হিসাবে গ্রহণ করেন।

প্রশ্নঃ (৭৩) যাদু কাকে বলে? যাদু শিক্ষার হুকুম কি?
উত্তরঃ আলেমগণ বলেন, যাদু বলা হয় প্রত্যেক এমন ক্রিয়া-কলাপকে, যার কারণ অস্পষ্ট ও গোপন থাকে, কিন্তু বাইরে তার প্রভাব দেখা যায়। গণক এবং জ্যোতিষের কার্যকলাপও যাদূর অন্তর্ভুক্ত। চাকচিক্যময় বক্তব্য ও ভাষার প্রভাবকেও যাদু বলা হয়। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

)إِنَّ مِنَ الْبَيَانِ لَسِحْرًا(

“নিশ্চয়ই কিছু কিছু বক্তৃতার মধ্যে যাদু রয়েছে।” সুতরাং প্রতিটি বস্তর গোপন প্রভাবকে যাদু বলা হয়।

আর পরিভাষায় এমন কিছু গিরা এবং ঝাড়ফুঁকের নাম, যা মানুষের অন্তর, মস্তিষ্ক এবং শরীরের ভিতরে প্রভাব বিস্তার করতঃ কখনো জ্ঞান শুণ্য করে ফেলে, কখনো ভালবাসা বা ঘৃণা সৃষ্টি করে এবং স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটায়। কখনো শরীর অসুস্থ করে দেয়। যাদু শিক্ষা করা হারাম। শুধু তাই নয়, বরং তা কখনো কুফরী এবং শির্কের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ

)وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوتَ وَمَارُوتَ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّى يَقُولَا إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ وَمَا هُمْ بِضَارِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ وَلَقَدْ عَلِمُوا لَمَنْ اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ(

“সুলাইমানের রাজত্বকালে শয়তানরা যা আবৃত্তি করতো, তারা তারই অনুসরণ করছে এবং সুলায়মান (আঃ) অবিশ্বাসী হননি, কিন্তু শয়তানরাই অবিশ্বাস করছিল, তারা লোকদেরকে যাদু বিদ্যা এবং যা বাবেল শহরে হারূত-মারূত ফেরেশতাদ্বয়ের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল, তা শিক্ষা দিতো এবং উভয়ে কাউকে ওটা শিক্ষা দেয়ার পূর্বে তারা বলতো যে, আমরা পরীক্ষা ছাড়া কিছুই নই, অতএব তোমরা কুফরী করো না, অনন্তর যাতে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সংঘটিত হয়, তারা উভয়ের নিকট তাই শিক্ষা করতো এবং তারা আল্লাহর আদেশ ব্যতীত তদ্বারা কারও অনিষ্ট করতে পারতো না এবং তারা ওটাই শিক্ষা করত, যাতে তাদের ক্ষতি হয় এবং তাদের কোন উপকার সাধিত না হয়। নিশ্চয় তারা জ্ঞাত আছে যে, যে কেউ ওটা ক্রয় করবে, তার জন্যে পরকালে কোন অংশ নেই।” (সূরা বাকারাঃ ১০২) সুতরাং শয়তানকে শরীক বানানোর মাধ্যমে এ ধরণের যাদু শিক্ষা এবং ব্যবহার করা কুফরী এবং সীমা লংঘনের অন্তর্ভুক্ত। এই জন্যেই যাদুকরের শাস্তি হল মৃত্যুদন্ড। তার যাদূর সীমা যদি কুফরী পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তাহলে তাকে কাফের এবং মুরতাদ হিসাবে হত্যা করতে হবে। আর তার যাদু যদি কুফরী পর্যন্ত না পৌঁছে, তাহলে মুসলমানদেরকে তার ক্ষতি হতে হেফাজত করার জন্য তাকে দন্ড প্রয়োগ করে করে হত্যা করতে হবে।

প্রশ্নঃ (৭৪) যাদুর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মিল-মিশের ব্যবস্থা করার হুকুম কি?
উত্তরঃ যাদুর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালবাসা তৈরী করা হারাম। অনুরূপভাবে যাদুর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করাও হারাম। কখনো কখনো শির্কে পরিণত হয়। আল্লাহ বলেনঃ

)وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّى يَقُولَا إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ وَمَا هُمْ بِضَارِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ وَلَقَدْ عَلِمُوا لَمَنْ اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ(

“এবং উভয়ে কাউকেও ওটা শিক্ষা দিতো না, এমনকি তারা বলতো যে, আমরা পরীক্ষা ছাড়া কিছুই নয়, অতএব তোমরা কুফরী করো না, অনন্তর যাতে স্বামী ও তদীয় স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সংঘটিত হয়, তারা উভয়ের নিকট তাই শিক্ষা করতো এবং তারা আল্লাহর আদেশ ব্যতীত তদ্বারা কারও অনিষ্ট করতে পারতো না এবং তারা ওটাই শিক্ষা করত, যাতে তাদের ক্ষতি হয় এবং তাদের কোন উপকার সাধিত না হয়, এবং নিশ্চয় তারা জ্ঞাত আছে আছে যে, অবশ্য যে কেউ ওটা ক্রয় করেছে তার জন্যে পরকালে কোন অংশ নেই। (সূরা বাকারাঃ ১০২)

প্রশ্নঃ (৭৫) গণক কাকে বলে? গণকের কাছে যাওয়ার বিধান কি?
উত্তরঃ গণক এমন লোককে বলা হয়, যে অনুমানের উপর নির্ভর করে ভিত্তিহীন বিষয়ের অনুসন্ধান করে থাকে। জাহেলী যামানার কিছু পেশাদার লোকের সাথে শয়তানের যোগাযোগ ছিল। শয়তানেরা চুরি করে আকাশের সংবাদ শ্রবণ করত এবং তাদের কাছে বলে দিত। আকাশ থেকে যা শ্রবণ করত, তার সাথে আরো অনেক মিথ্যা কথা সংযোগ করে মানুষের মধ্যে তা প্রকাশ করত। তারা যা বলত, তার একটি কথা সত্য হলে মানুষ ধোকায় পড়ে যেত এবং অন্যান্য সমস্যার সমাধানের জন্য ও ভবিষ্যতে কি হবে, তা জানতে গণকদের কাছে আসা শুরু করত। এই জন্যই আমরা বলি যে, গণক হচ্ছে সেই লোক, যে ভবিষ্যতের অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে সংবাদ দিয়ে থাকে। যারা গণকের কাছে আসে, তারা তিনভাগে বিভক্তঃ

(১) গণকের কাছে এসে তাকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করা এবং তার কথায় বিশ্বাস না করা। এটা হারাম। এ ধরণের লোক সম্পর্কে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

)مَنْ أَتَى عَرَّافًا فَسَأَلَهُ عَنْ شَيْءٍ لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلَاةٌ أَرْبَعِينَ لَيْلَةً(

“যে ব্যক্তি গণকের কাছে গিয়ে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করল, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার নামায কবূল হবে না।”

(২) গণকের কাছে এসে তাকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করা এবং তার কথায় বিশ্বাস করা। এটা আল্লাহর সাথে কুফরী করার অন্তর্ভুক্ত। কারণ সে ইলমে গায়েবের দাবীতে গণককে বিশ্বাস করেছে। মানুষ ইলমে গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করলে আল্লাহর কথাকে অবিশ্বাস করা হবে। আল্লাহ বলেনঃ

)قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ(

“বলুন, আকাশ এবং জমিনে আল্লাহ ছাড়া গায়েবের সংবাদ অন্য কেউ জানে না।” (সূরা নমলঃ ৬৫) ছহীহ হাদীছে এসেছে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

مَنْ أَتَى كَاهِنًا فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ

“যে ব্যক্তি কোন গণকের নিকট গমণ করে তার কথায় বিশ্বাস করল, সে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর উপর অবতীর্ণ বিষয় (কুরআন ও সুন্নাহ)র সাথে কুফরী করল।” এ ধরণের মানুষ তাওবা না করে মৃত্যু বরণ করলে কুফরী অবস্থায় তার মৃত্যু হবে।

(৩) গণককে পরীক্ষার জন্য এবং মানুষের সামনে তার ধোঁকাবাজির কথা তুলে ধরার জন্য তার কাছে যেতে কোন অসুবিধা নেই। ইবনু সায়্যাদ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর কাছে আগমণ করলে তিনি মনের মধ্যে একটি কথা গোপন করে ইবনে সায়্যাদকে জিজ্ঞাসা করলেন, বল তো আমি কি গোপন করেছি? ইবনে সায়্যাদ বলল, আদ্‌-দুখ্‌ অর্থাৎ আদ্‌-দুখান (ধোঁয়া)। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, অকল্যাণ হোক তোমার! তুমি তোমার সীমা অতিক্রম করতে পারবে না।

প্রশ্নঃ (৭৬) রিয়া বা মানুষকে দেখানো ও শুনানোর নিয়তে ইবাদত করার বিধান কি?
উত্তরঃ যে ইবাদত ‘রিয়া’ মিশ্রিত হয় তা তিনি প্রকারঃ

প্রথম প্রকারঃ ইবাদত মূলতঃ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যই করা হয়। যেমন দৃষ্টি আকর্ষণ এবং মানুষের প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্য ‘সালাত’ আদায় করা। ইহা শিরক এবং এ প্রকার ইবাদত বাতিল।
দ্বিতীয় প্রকারঃ ইবাদত করার মধ্যবর্তী অবস্থায় ‘রিয়ায়’ পতিত হওয়া। অর্থাৎ যেমন ইবাদত শুরুর সময় একনিষ্ঠভাবে অরম্ভ করে কিন্তু ইবাদতের মধ্যবর্তী সময়ে ‘রিয়া’ সৃষ্টি হয়। এ ধরনের ইবাদত দু’অবস্থা হতে খালি নয়ঃ

প্রথম অবস্থাঃ যদি উক্ত ইবাদতের প্রথমাংশ শেষাংশের সাথে সম্পৃক্ত না থাকে তাহলে প্রথমাংশ শুদ্ধ হবে এবং দ্বিতীয় অংশ বাতিল হবে। এর উদাহরন হল, যেমন কোন ব্যাক্তি একশত টাকা দান করার ইচ্ছা পোষণ করল। এর মধ্যে ৫০টাকা দান করল খালেস নিয়তে। বাকী ৫০টাকা দান করল লোক দেখানোর নিয়তে। পরের ৫০টাকা দান করার সময় রিয়া মিশ্রিত হওয়ার কারণে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।

দ্বিতীয় অবস্থাঃ যদি ইবাদতটির শেষাংশ প্রথমাংশের উপর ভিত্তিশীল হয় তবে এর দুটি অবস্থা।
(ক) ইবাদতকারী ব্যাক্তি ‘রিয়াকে’ প্রতিহত করবে এবং ‘রিয়ার’ উপর স্থির হবে না। এমতাবস্থায় ‘রিয়া’ ইবাদতে কোন প্রকার প্রভাব ফেলবে না, অথবা কোন ক্ষতিও করবে না। যেমন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ নিশ্চয় আল্লাহ আমার উম্মাতের মনের মধ্যে যেসমস- কথা উদিত হয় সেগুলোকে ক্ষমা করে দিবেন। যদি তা কাজে পরিণত না করে বা মুখে তা উচ্চারণ না করে।

(খ) অপর অবস্থাটি হলঃ ইবাদতকারী ‘রিয়ার’ প্রতি তুষ্ট থাকবে এবং ‘রিয়া’কে অন্তরে প্রতিহত করবে না। এমতাবস্থায় তাঁর পূর্ণ ইবাদতটি বাতিল হয়ে যাবে। কেননা ইবাদতের শেষাংশ প্রথমাংশের উপর ভিত্তিশীল। যেমন কোন ব্যাক্তি ‘সালাতে’ দাঁড়াল ইখলাসের সাথে, অতঃপর দ্বিতীয় রাকাতে তাঁর অন্তরে ‘রিয়া’র উদয় হল এবং উক্ত ব্যাক্তি ‘রিয়া’র প্রতি তুষ্ট থাকল (অন্তরে ‘রিয়া’কে প্রতিহত করল না) এমতাবস্থায় পূর্ণ ‘সালাত’ বাতিল হয়ে যাবে। কেননা ‘সালাতের’ শেষাংশের সাথে প্রথমাংশ সম্পৃক্ত রয়েছে।
তৃতীয় প্রকারঃ ইবাদত সমাপ্ত করার পর যদি ইবাদতকারীর অন্তরে ‘রিয়া’র উদ্ভব ঘটে, তবে তা ইবাদতে কোন প্রকার প্রভাব ফেলবে না বা ইবাদতটি বাতিলও হবেনা। কারণ বিশুদ্ধভাবে তা সম্পাদিত হয়েছে। সম্পাদিত হওয়ার পর রিয়ার কারণে তা নষ্ট হবেনা।

ইবাদত দেখে কেউ প্রশংসা করলে এবং তাতে ইবাদতকারী খুশী হলে তা রিয়ার অন্তর্গত হবেনা। কারণ এটি ইবাদত সমাপ্ত হওয়ার পর প্রকাশিত হয়েছে। আনুগত্যের কাজ করার পর মানুষ খুশী হবে, এটাই স্বাভাবিক। বরং এটি তার ঈমানের প্রমাণ বহন করে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

مَنْ سَرَّتْهُ حَسَنَتُهُ وَسَاءَتْهُ سَيِّئَتُهُ فَذَلِكُمُ الْمُؤْمِنُ

“নেকীর কাজ করে যে খুশী হয় এবং পাপের কাজকে যে খারাপ মনে করে, সেই প্রকৃত মুমিন।” রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
تِلْكَ عَاجِلُ بُشْرَى الْمؤْمِنِ ইহা মু’মিনের আগাম শুভ সংবাদ।

প্রশ্নঃ (৭৭) কুরআন নিয়ে শপথ করার হুকুম কি?
উত্তরঃ এই প্রশ্নের উত্তর একটু বিস্তারিতভাবে দেয়া প্রয়োজন। যখন একজন ব্যক্তি কোন বস্তর নামে শপথ করে, তখন উক্ত বস্তকে সম্মানিত মনে করেই করে থাকে। এ জন্যই আল্লাহ বা তাঁর অন্য কোন নাম অথবা কোন সিফাত (গুণাবলী) ব্যতীত অন্য বস্তর নামে শপথ করা জায়েয নেই। যেমন কেউ বলল, আল্লাহর শপথ! আমি একাজটি অবশ্যই করব অথবা বলল কাবা ঘরের প্রভুর শপথ! আল্লাহর বড়ত্বের শপথ! ইত্যাদি।

কুরআন মাজীদ আল্লাহর কালাম (কথা)। আল্লাহর কথা তাঁর সিফাতের অন্তর্ভুক্ত। কথা বলা আল্লাহর সত্বাগত সিফাত। তিনি সদাসর্বদা এ গুণে গুণান্বিত। যখন ইচ্ছা, তখনই তিনি কথা বলেন। কথা বলার শক্তি থাকা বা বাকশক্তি থাকা একটি পূর্ণতার গুণ। আল্লাহ তাআ’লা সকল দিক থেকে পরিপূর্ণ। তাই কথা বলা আল্লাহর একটি সত্বাগত গুণ। যখন ইচ্ছা, তখনই তিনি কথা বলেন, এই দৃষ্টি কোন থেকে কথা বলা একটি কর্মগত গুণ। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ

)إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ(

“তাঁর ব্যাপার শুধু এই যে, যখন তিনি কোন কিছুর ইচ্ছা করেন, তখন ওকে বলেনঃ হয়ে যাও, ফলে তা হয়ে যায়।” (সূরা ইয়াসীনঃ ৮২) এখানে কথা বলাকে ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ যখন ইচ্ছা কথা বলেন। এব্যাপারে আরো অনেক দলীল রয়েছে। যারা বলে আল্লাহ সদাসর্বদা কথা বলার গুণে গুণান্বিত, কিন্তু আল্লাহর কথা তাঁর সত্বার সাথে সম্পৃক্ত, বাইরে এর কোন প্রভাব নেই বা কেউ তাঁর কথা শ্রবণ করতে পারে না, তাদের মতবাদ সম্পূর্ণ ভুল। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া তাদের মাযহাব বাতিল হওয়ার ব্যাপারে ৯০টি যুক্তি বর্ণনা করেছেন।

যেহেতু কুরআন মাজীদে আল্লাহর কালাম রয়েছে, আর আল্লাহর কালাম তাঁর সিফাতের অন্তর্ভুক্ত, তাই কুরআনের শপথ করা জায়েয আছে। হান্বলী মাযহাবের ফকীহগণ এটাকে বৈধ বলেছেন। শ্রোতাদের বুঝতে অসুবিধা হয় এমন শব্দ উচ্চারণ করে শপথ করা ঠিক নয়। সাধারণ লোকেরা যাতে বুঝতে পারে, এমন শব্দ দ্বারা শপথ করা উচিৎ। কেননা মানুষ বুঝতে পারে এবং তাদের অন্তরে স্বসি- অর্জিত হয়, এমন বক্তব্য মানুষের কাছে পেশ করাই উত্তম। শপথ যেহেতু আল্লাহ, তাঁর নাম এবং সিফাতের মাধ্যমেই করতে হবে, তাই গাইরুল্লাহর নামে, নবীর নামে, জিবরীল ফেরেশতার নামে, কাবার নামে বা অন্য কোন মাখলুকের নামে শপথ করা জায়েয নয়। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

مَنْ كَانَ حَالِفًا فَلْيَحْلِفْ بِاللَّهِ أَوْ لِيَصْمُتْ

“যে ব্যক্তি শপথ করতে চায় সে যেন আল্লাহর নামে শপথ করে অথবা যেন চুপ থাকে।” নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেনঃ

مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْ كَفَرَ أَوْ أَشْرَكَ

“যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর নামে শপথ করল, সে কুফরী বা শির্‌ক করল।” কেউ যদি কোন মানুষকে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর হায়াত কিংবা অন্য ব্যক্তির নামে শপথ করতে দেখে, তা হলে সে যেন তাকে নিষেধ করে এবং বলে দেয় যে, এটা হারাম। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, আদেশ বা নিষেধ যাতে নম্র ভাষায় হয়। যাতে করে সে সহজেই নসীহত কবূল করতে পারে। কেননা অনেক মানুষ রয়েছে, যারা রাগাম্বিত হয়ে মানুষকে আদেশ-নিষেধ করে থাকে। অনেক সময় তাদের চেহারা রক্তিম হয়ে যায়। মনে হয় সে যেন নিজের প্রতিশোধ নিচ্ছে। এতে করে শয়তান সুযোগ পেয়ে যায়। মানুষ যদি পরস্পরকে সম্মান করতো, হিকমত এবং নম্রতার সাথে তাকে দ্বীনের দিকে দাওয়াত দিতো, তা হলে তাদের কথা অধিক গ্রহণযোগ্য হতো। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

إِنَّ اللَّهَ يُعْطِي عَلَى الرِّفْقِ مَا لَا يُعْطِي عَلَى الْعُنْفِ

“নিশ্চয় আল্লাহ নম্রতার মাধ্যমে যা দান করেন, কঠোরতার মাধ্যমে তা দান করেন না।”

একদা জনৈক গ্রাম্যলোক মসজিদে নববীতে এসে পেশাব করে দিল। লোকেরা তাকে ধমকাতে শুরু করল। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে ধমকাতে নিষেধ করলেন। লোকটি যখন পেশাব শেষ করল, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে কাছে ডেকে এনে বললেন, এ সকল মসজিদ আল্লাহর ঘর, পেশাব বা ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্থান নয়। তা কেবলমাত্র আল্লাহর বড়ত্ব বর্ণনা করা, তাসবীহ পাঠ করা এবং কুরআন তেলাওয়াত করার জন্যই নির্দিষ্ট। অতঃপর তিনি ছাহাবীদেরকে পেশাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দেয়ার আদেশ দিলেন। এতেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল এবং মসজিদ পবিত্র হয়ে গেল। সাথে সাথেগ্রাম্য লোকটিকে উপদেশ দেয়ার উদ্দেশ্যও সফল হয়ে গেল। আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদেরকেও এরূপ হওয়া উচিৎ। আমরা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য পন্থায় সত্যকে তুলে ধরব। আল্লাহ সবাইকে তাওফীক দিন।

প্রশ্নঃ (৭৮) নবীর নামে, কাবার নামে এবং মানমর্যাদা ও জিম্মাদারীর নামে শপথ করার বিধান কি?
উত্তরঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নামে শপথ করা জায়েয নয়; বরং ইহা শির্কের অন্তর্ভুক্ত। এমনিভাবে কাবার নামে শপথ করা শির্ক। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং কাবা উভয়টিই মাখলুক। আর কোন মাখলুকের নামে শপথ করাই শির্ক। এমনিভাবে সম্মান এবং জিম্মাদারীর শপথ করাও শির্ক। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْ كَفَرَ أَوْ أَشْرَك

“যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর নামে শপথ করল, সে কুফরী বা শির্‌ক করল।” ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

أَنَّهُ أَدْرَكَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ فِي رَكْبٍ وَهُوَ يَحْلِفُ بِأَبِيهِ فَنَادَاهُمْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَلَا إِنَّ اللَّهَ يَنْهَاكُمْ أَنْ تَحْلِفُوا بِآبَائِكُمْ فَمَنْ كَانَ حَالِفًا فَلْيَحْلِفْ بِاللَّهِ وَإِلَّا فَلْيَصْمُتْ

“তিনি তাঁর পিতা উমার (রাঃ)কে পিতার নামে শপথ করতে শুনলেন। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাফেলার লোকজনকে ডেকে বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে পিতার নামে শপথ করতে নিষেধ করছেন। যে ব্যক্তি শপথ করতে চায়, সে যেন আল্লাহর নামে শপথ করে অথবা চুপ থাকে।” কিন্তু “আমার জিম্মায়” একথাটি শপথ নয়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল অঙ্গিকার।

প্রশ্নঃ (৭৯) যে ব্যক্তি কবরের চতুর্দিকে তাওয়াফ করে, কবরবাসীর কাছে দু’আ করে এবং তাদের জন্য নযর-মানত পেশসহ অন্যান্য ইবাদত করে থাকে, তার হুকুম কি?
উত্তরঃ এটি একটি বিরাট প্রশ্ন। বিস্তারিতভাবে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া দরকার। তাই আমরা বলব যে, কবরবাসীগণ দু’প্রকারঃ

(১) যারা ইসলামের উপর মৃত্যু বরণ করেছে এবং মানুষ তাদের প্রশংসা করে থাকে, আশা করা যায় এদের পরিণতি ভাল হবে কিন্তু তারা মুসলমান ভাইয়ের দু’আর মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তাআ’লা বলেনঃ

)رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ(

অর্থঃ “হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে আগ্রণী আমাদের ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়।” (সূরা হাশরঃ ১০) মৃত ব্যক্তি নিজের অকল্যাণ দূর করতে বা কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম নয়। তা হলে কিভাবে সে অপরের কল্যাণ করতে পারবে অথবা অপরের পক্ষ হতে অকল্যাণ দূর করতে পারবে?

(২) যারা ইসলাম বিনষ্টকারী বিষয় শির্কের মত পাপ নিয়ে মৃত্যু বরণ করেছে তারা দাবী করতো যে তারা আল্লাহর ওলী, তারা গায়েবের খবর রাখে। এমনকি রুগীর আরোগ্য দান, মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণ সাধনের দাবীও করে থাকে। এরা কুফরী অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছে। এদের জন্য দু’আ করা এবং আল্লাহর কাছে তাদের জন্য রহমত কামনা করা জায়েয নেই।

)مَاكَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُوْلِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ (

“নবী ও মুমিনদের উচিৎ নয় মুশরেকদের জন্য মাগফেরাত কামনা করা। যদিও তারা নিকটাত্মীয় হোক- একথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে, তারা দোযখী। আর ইবরাহীম কর্তৃক স্বীয় পিতার মাগফেরাত কামনা ছিল কেবল সেই প্রতিশ্রুতির কারণে, যা তিনি তার সাথে করেছিলেন। অতঃপর যখন তাঁর কাছে এ কথা প্রকাশ পেল যে, সে আল্লাহর শত্রু, তখন তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলেন। নিঃসন্দেহে ইবরাহীম ছিলেন বড় কোমল হৃদয়, সহনশীল।” (সূরা তাওবাঃ ১১৩-১১৪) কবরবাসীগণ কারো ক্ষতি বা কল্যাণ করতে পারে না। তাই কবরবাসীদের কাছে এগুলো কামনা করা জায়েয নেই। যদিও কোন কোন কবর থেকে কারামাত প্রকাশ পেয়ে থাকে। যেমন কবর থেকে আলো বের হওয়া, সুঘ্রাণ বের হওয়া ইত্যাদি। অথচ তারা শির্কের উপরে মৃত্যু বরণ করেছে। তাদের কবর থেকে যদি এরূপ কিছু বের হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে, এটি ইবলীস শয়তানের ধোঁকা মাত্র।

মুসলমানদের উচিৎ শুধুমাত্র আল্লাহর উপর সকল প্রকার আশা-ভরসা করা। কেননা তাঁর হাতেই আকাশ-জমিনের একমাত্র রাজত্ব। তাঁর দিকেই সকলে প্রত্যাবর্তন করবে। তিনিই ফরিয়াদকারীর দু’আ কবূল করেন এবং মানুষের অকল্যাণ দূর করেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেনঃ

)وَمَا بِكُمْ مِنْ نِعْمَةٍ فَمِنْ اللَّهِ ثُمَّ إِذَا مَسَّكُمْ الضُّرُّ فَإِلَيْهِ تَجْأَرُونَ (

“তোমাদের কাছে যে সমস্ত নেয়ামত আছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। অতঃপর যখন তোমরা দুঃখ-কষ্টে পতিত হও, তখন তাঁরই নিকট কান্নাকাটি কর।” ( সূরা নাহ্‌লঃ ৫৩) মুসলমানদের জন্য আমার আরো নসীহত এই যে, তারা যেন দ্বিনী বিষয়ে কারো তাকলীদ না করে এবং একমাত্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নিঃশর্ত অনুসরণ করে। আল্লাহ বলেনঃ

)وَلَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِى رَسُوْلِ اللَّهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الآخِرَ (

“তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহকে বেশী করে স্মরণ করে, পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহর সন’ষ্টি কামনা করে, তাদের জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।” (সূরা আহযাবঃ ২১) আল্লাহ বলেন,

)قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمْ اللَّه(ُ

“বলুন যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন।” (সূরা আল-ইমরানঃ ৩১)

মুসলমানদের উপর আবশ্যক হল, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওলী হওয়ার দাবী করে, তারা যেন তার আমলগুলোকে কুরআন্তসুন্নাহর কষ্টি পাথরে যাচাই করে দেখে। তার আমলগুলো যদি আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাত মোতাবেক হয়, তাহলে আশা করা যায় যে, সে আল্লাহর ওলী। আর যদি তার ভিতরে কুরআন্তসুন্নাহ বিরোধী আমল পাওয়া যায়, তাহলে কোন ক্রমেই সে আল্লাহর ওলী হতে পারে না। আল্লাহ তাআ’লা তাঁর কিতাবে ওলী হওয়ার মানদন্ড বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,

)أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ(

“জেনে রেখো, যারা আল্লাহর ওলী, তাদের না আছে কোন ভয়-ভীতি, না তারা চিন্তিত হবে। যারা ঈমান এনেছে এবং তারা ভয় করে চলে।” (সূরা ইউনুসঃ ৬২-৬৩) সুতরাং যে মুমিন্তমুত্তাকী, সেই আল্লাহর ওলী। আর যে ব্যক্তির ভিতরে ঈমান এবং তাকওয়া নেই, সে আল্লাহর ওলী হতে পারে না। যার ভিতরে যতটুকু ঈমান ও আমল রয়েছে, তার ভিতরে ততটুকু আল্লাহর বন্ধুত্ব রয়েছে। তবে আমরা নির্দিষ্ট করে কাউকে আল্লাহর ওলী হিসাবে সার্টিফিকেট দিতে পারি না। আমরা বলতে পারি, যিনি মুমিন্তমুত্তাকী হবেন তিনি আল্লাহর ওলী হবেন।

কবরের ভক্তরা কবরবাসীর কাছে দু’আ করলে অথবা কবর থেকে মাটি নিলে যদিও কখনো কখনো তাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়, তথাপিও এটা বিশ্বাস করা যাবে না যে, কবরবাসীই উক্ত উদ্দেশ্য অর্জনের কারণ। এটি কবরবাসীর কাছে দু’আকারীর জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে ফিতনার কারণও হতে পারে। কারণ আমরা জানি যে, কবরবাসী কারও দু’আ কবূল করার ক্ষমতা রাখেন না কিংবা কবরের মাটি কল্যাণ আনয়ন করতে বা ক্ষতি দমন করতে সক্ষম নয়। আল্লাহ বলেনঃ

)وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لَا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ كَانُوا لَهُمْ أَعْدَاءً وَكَانُوا بِعِبَادَتِهِمْ كَافِرِين(

“যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে এমন বস্তকে আহবান করে, যে কেয়ামত পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দেবে না, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? তারা তো তাদের আহবান সম্পর্কেও বেখবর। যখন মানুষকে হাশরে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রুতে পরিণত হবে এবং তাদের ইবাদত অস্বীকার করবে।” (সূরা আহকাফঃ ৫-৬) আল্লাহ বলেন,

)وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَخْلُقُونَ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ أَمْوَاتٌ غَيْرُ أَحْيَاءٍ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ(

“এবং যারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যদের ডাকে ওরা তো কোন বস্তই সৃষ্টি করে না, বরং ওরা নিজেরাই সৃজিত। তারা মৃত-প্রাণহীন এবং কবে তারা পুনরুত্থিত হবে, তাও জানে না।” (সূরা নাহলঃ ২০-২১)

এই মর্মে আরো অনেক আয়াত রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ ছাড়া যাকেই ডাকা হোক না কেন, ডাকে সাড়া দিবে না এবং আহবানকারীর কোন উপকারও করতে পারবে না।

তবে কখনও কখনও আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট দু’আ করার সময় প্রার্থিত বস্ত অর্জিত হয়ে হয়ে থাকে। আল্লাহর পক্ষ হতে ইহা একটি পরীক্ষা মাত্র। আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদেরকে পাপ কাজের মাধ্যমে পরীক্ষা করে থাকেন। যাতে তিনি জানতে পারেন কে আল্লাহর খাঁটি বান্দা আর কে প্রবৃত্তির অনুসারী।

আপনি জানেন না যে শনিবারের দিন আল্লাহ তা’আলা ইহুদীদের উপর মাছ শিকার করা হারাম করেছিলেন? ঐ দিকে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য শনিবারের দিন প্রচুর পরিমাণ মাছ সাগরের কিনারায় পাঠিয়ে দিলেন। শনিবার ছাড়া অন্য দিনে মাছগুলো লুকিয়ে থাকত। এভাবে দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হল। ইহুদীরা বললঃ কিভাবে আমরা এ মাছগুলো থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখব? অতঃপর তারা চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিল যে, আমরা জাল তৈরী করে শনিবার দিন তা সাগরে ফেলে রাখবে আর রবিবারের দিন মাছ শিকার করব। আল্লাহর হারামকৃত জিনিষকে হালাল করার জন্য তারা কৌশল অবলম্ভন করল। পরিণামে আল্লাহ তাদেরকে বানরে পরিণত করে দিলেন। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

)وَاسْأَلْهُمْ عَنْ الْقَرْيَةِ الَّتِي كَانَتْ حَاضِرَةَ الْبَحْرِ إِذْ يَعْدُونَ فِي السَّبْتِ إِذْ تَأْتِيهِمْ حِيتَانُهُمْ يَوْمَ سَبْتِهِمْ شُرَّعًا وَيَوْمَ لَا يَسْبِتُونَ لَا تَأْتِيهِمْ كَذَلِكَ نَبْلُوهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ(

আর তাদের কাছে সে জনপদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করুন যা ছিল সাগরের তীরে অবসি’ত। যখন শনিবার দিনের নির্দেশের ব্যাপারে সীমাক্রিম করতে লাগল। যখন শনিবারের দিন মাছগুলো আসতে লাগল তাদের কাছে দলে দলে। আর যেদিন শনিবার হতনা সে দিন আসতনা। এভাবে আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি। কারণ তারা ছিল নাফরমান। (সূরা আ’রাফঃ ১৬৩) লক্ষ করুন! যেদিন তাদের জন্য মাছ ধরা নিষেধ ছিল সেদিন কিভাবে আল্লাহ তাদের জন্য মাছগুলো তাদের আয়ত্তে এনে দিয়েছিল? কিন্তু তারা ধৈর্য ধারণ করতে পারেনি। তাই আল্লাহর হারামকৃত জিনিষকে হালাল করার জন্য তারা কৌশল অবলম্ভন করল।

আরো লক্ষ করুন নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাথীদের প্রতি। তারা ছিলেন ইহ্‌রাম অবস্থায়। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাদের নিকট এমন কিছু শিকারযোগ্য প্রাণী পাঠিয়ে পরীক্ষা করলেন যা ছিল তাদের জন্য হারাম। প্রাণীগুলো তাদের হাতের নাগালে ছিল। কিন্তু সাহাবীগণ কোন জন্তু শিকার করেন নি। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

)يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَيَبْلُوَنَّكُمْ اللَّهُ بِشَيْءٍ مِنْ الصَّيْدِ تَنَالُهُ أَيْدِيكُمْ وَرِمَاحُكُمْ لِيَعْلَمَ اللَّهُ مَنْ يَخَافُهُ بِالْغَيْبِ فَمَنْ اعْتَدَى بَعْدَ ذَلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ(

“হে মু’মিন আল্লাহ তোমাদেরকে এমন কিছু শিকারের মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন যে শিকার পর্যন্ত তোমাদের হাত ও বর্শা সহজেই পৌঁছতে পারবে- যাতে আল্লাহ বুঝতে পারেন যে, কে তাঁকে অদৃশ্যভাবে ভয় করে। অতএব যে ব্যক্তি এরপরও সীমা অতিক্রম করবে তার জন্য যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি রয়েছে। (সূরা মায়িদাহঃ ৯৪)

সুতরাং শিকারগুলো ছিল তাদের হাতের নাগালে। মাটিতে চলাচলকারী প্রাণীগুলো হাতেই ধরা যেত। উড়ন্ত পাখিগুলো বর্শা দিয়েই শিকার করা যেত। শিকার ধরা ছিল অত্যন্ত সহজ। কিন্তু সাহাবীগণ আল্লাহকে ভয় করেছেন এবং কোন প্রাণীই শিকার করেন নি।

এমনিভাবে কোন মানুষের জন্য যখন হারাম কাজ করা সহজ হয়ে যাবে তখন আল্লাহকে ভয় করে উক্ত হারাম কাজ থেকে বিরত থাকবে। এবং এটা মনে রাখবে যে, কারো জন্য হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার পথ সহজ করে দেয়া তার জন্য একটি পরীক্ষা স্বরূপ। কাজেই ধৈর্য ধারণ করা উচিত। পরহেজগারদের জন্যই উত্তম পরিণতি।

প্রশ্নঃ (৮০) যে সমস্ত কবর পূজারী নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর কবর মসজিদের ভিতরে হওয়াকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে, আমরা কিভাবে তাদের উত্তর দিব?
উত্তরঃ উক্ত প্রশ্নের উত্তর আমরা কয়েকভাবে দিতে পারিঃ-

১) মসজিদটি মূলতঃ কবরের উপর নির্মাণ করা হয়নি; বরং এ মসজিদ নির্মিত হয়েছে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর জীবদ্দশায়।

২) নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে মসজিদে দাফন করা হয়নি। কাজেই একথা বলার অবকাশ নেই যে ইহাও সৎ ব্যক্তিদেরকে মসজিদে দাফন করার কুপ্রথার অন্তর্ভুক্ত। বরং নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে তাঁর নিজ ঘরে দাফন করা হয়েছে।

৩) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ঘরগুলোকে মসজিদে প্রবেশ করানো ছাহাবীদের যৌথ সিদ্ধানে- হয়নি বরং তাদের অধিকাংশের মৃত্যুর পর হয়েছে। তখন তাঁদের অল্প কয়েকজন মাত্র বেঁচে ছিলেন। উহা ঘটেছিল ৯৪ হিঃ সনে মসজিদ সম্প্রসারণ কালে। এই কাজটি ছাহাবীদের অনুমতি বা তাদের যৌথ সিদ্ধানে- হয়নি। তাদের কেউ কেউ উহাতে বিরোধীতাও করেছিলেন। তাবেয়ীদের মধ্যে সাঈদ বিন মুসাইয়্যেব তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

৪) কবরটি মূলতঃ মসজিদের ভিতরে নয়। কারণ উহা মসজিদ হতে সমপূর্ণ পৃথক কক্ষে রয়েছে। আর মসজিদকে ওর উপর বানানো হয়নি। এজন্যই এই স্থানটিকে তিনটি প্রাচীর দ্বারা সংরক্ষিত ও বেষ্টিত করা হয়েছে। আর উত্তর দিকের প্রাচীরটি ত্রিভুজের মত করে রাখা হয়েছে। এতে করে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর কবরটি সরাসরি মুছল্লীর সামনে পড়ে না। আশা করি কবর পূজারীদের দলীল খন্ডনে উপরোক্ত উত্তরগুলোই যথেষ্ট হবে।

উৎসঃ ফতোওয়া আরকানুল ইসলাম

মন্তব্য করুন

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button