প্রবন্ধ

সাহাবায়ে কেরাম ও ইমামগণকে গালি দেওয়া নিষিদ্ধ

প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না

শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।

অনুবাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী | সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

সাহাবায়ে কেরাম ও ইমামগণকে গালি দেওয়া নিষিদ্ধ

এক. সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া নিষিদ্ধ:

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের একটি মূলনীতি হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের ব্যাপারে তাদের অন্তর এবং বাক-যন্ত্র পাক-পবিত্র ও সংযত থাকবে- যেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অনুরূপ গুণসম্পন্ন বলে বর্ণনা করেছে,

﴿ وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠﴾ [الحشر: ١٠] 

“আর যারা তাদের পরে আগমন করেছে, তারা বলে: হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং আমাদের আগে আমাদের যে সব ভাইয়েরা ঈমান এনেছে তাদেরকে ক্ষমা করুন। আর ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! আপনি দয়ালু, পরম করুণাময়।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ১০]

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ বাণীর প্রতিও তারা আমল করবে,

«لَا تَسُبُّوا أَصْحَابِي، لَا تَسُبُّوا أَصْحَابِي، فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا، مَا أَدْرَكَ مُدَّ أَحَدِهِمْ، وَلَا نَصِيفَهُ»

“আমার সাহাবীগণকে তোমরা গালি-গালাজ করো না, আমার সাহাবায়ে কেরামকে তোমরা গালি-গালাজ করো না। যার হাতে আমার প্রাণ-তার কসম করে বলছি- যদি তোমাদের কেউ উহুদ পাহাড়ের সমপরিমাণ স্বর্ণও ব্যয় কর, তবে তাদের ব্যয় করা এক অঞ্জলি বা তার অর্ধেকের সমান পর্যন্ত ও পৌঁছবে না”।[1]

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত, রাফেযী ও খারেজীদের ভ্রষ্ট তরীকা থেকে মুক্ত- যারা সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে গালি দেয়, তাদের প্রতি বিদ্বেষ রাখে, তাদের ফযীলত ও মর্যাদা অস্বীকার করে এবং তাদের অধিকাংশকে কাফির বলে ঘোষণা দেয়।

কিতাব ও সুন্নায় সাহাবায়ে কেরামের যে ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে, আহলে সুন্নাত তা মেনে নেয় এবং বিশ্বাস করে যে, তারাই যুগের সর্বোত্তম প্রজন্ম। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«خَيْرُكُمْ قَرْنِيْ»

“আমার যুগের লোকেরাই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম”।[2]

একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বর্ণনা করেছিলেন যে, এ উম্মাত ৭৩টি ফিরকায় বিভক্ত হবে এবং তার মধ্যে একটি ছাড়া বাকিগুলো সবই জাহান্নামী হবে। তখন লোকেরা তাকে সে দলটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। তিনি বললেন,

«هُمْ مَنْ كَانَ عَلَى مِثْلِ مَا أنَا عَلَيْهِ اليَوْمَ وَأصْحَابِيْ»

“তারা হলো ঐ সব লোক যারা আমি এবং আমার সাহাবীগণ আজ যে আদর্শে আছি, তার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে”।[3]

ইমাম মুসলিমের সব চেয়ে বড় উস্তাদ ও শাইখ আবু যুর‘আ রহ. বলেন, যখন কোনো ব্যক্তিকে সাহাবায়ে কেরামের কারো দোষ বর্ণনা করতে দেখবে, তবে জানবে যে, নিশ্চয় সে যিন্দিক বা নাস্তিক। কেননা কুরআন সত্য, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত শরী‘আত সত্য। আর এ সকল কিছু সাহাবায়ে কেরামই আমাদের কাছে পৌঁছিয়েছেন। অতএব, যারা তাদের নিন্দা করে, তারা প্রকৃত পক্ষে কুরআন ও সুন্নাহকেই বাতিল করে দিতে চায়। তাই সাহাবীগণকে যারা নিন্দা করে, তারা নিজেরাই নিন্দিত হওয়ার উপযুক্ত এবং এদেরকে যিন্দিক ও ভ্রষ্ট বলে অবহিত করা খুবই সমীচীন।

আল্লামা ইবন হামদান তার ‘নেহায়াতুল মুবতাদিয়ীন’ গ্রন্থে বলেন: যে ব্যক্তি জায়েয মনে করে সাহাবীগণকে কাউকে গালি দেয়, সে কাফির হয়ে যাবে। আর জায়েয নয় মনে করে গালি দিলে সে ফাসিক হবে। তার থেকে একথাও বর্ণিত যে, উভয় অবস্থায়ই সে ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি তাদেরকে ফাসিক বলবে কিংবা তাদের দীনদারির প্রতি আঘাত করবে অথবা তাদেরকে কাফির বলবে, সে নিজেই কাফির হয়ে যাবে।

দুই. উম্মতের ওলামাদের অন্তর্গত আয়িম্মায়ে কিরামকে গালি দেওয়া নিষিদ্ধ:

ফযীলত, মর্যাদা ও সম্মানের দিক দিয়ে সাহাবাদের পরই আয়িম্মায়ে কেরামের স্থান। তন্মধ্যে রয়েছেন সম্মানিত যুগের তাবেঈন, তাবে তাবেঈন এবং তাদের পরে আগত ঐ সকল ব্যক্তি যারা সাহাবীগণের সঠিক অনুসারী ছিলেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحۡسَٰنٖ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُ﴾ [التوبة: ١٠٠]

“মুহাজির ও আনসারদের প্রথম অগ্রবর্তী দল এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০০]

তাই তাদের দোষ বর্ণনা করা ও তাদেরকে গালি দেওয়া বৈধ নয়। কেননা তারা হিদায়েতের পতাকাবাহী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥﴾ [النساء: ١١٥]

“হিদায়াতের পথ সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে ব্যক্তি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মু‘মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায়, সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং জাহান্নামে তাকে নিক্ষেপ করব। আর তা অতি নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তন স্থল।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১৫]

‘আত-তাহাবিয়া’ গ্রন্থের ব্যাখ্যাদাতা বলেন: প্রত্যেক মুসলিমের উচিত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে মুহব্বত ও বন্ধুত্ব রাখার পর মুমিনদের সাথেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা, যেমনিভাবে কুরআন নির্দেশ প্রদান করেছে- বিশেষ করে সে সব লোকের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা, যারা নবীগণের উত্তরাধিকারী এবং যাদেরকে আল্লাহ তারকারাজির মতো বলে বর্ণনা করেছেন। যাদের দ্বারা মানুষ স্থল ও জলের অমানিশায় পথ পেয়ে থাকে। সকল মুসলিম এ ব্যাপারে একমত যে, তারা হিদায়াতের ওপর ছিলেন এবং দীনকে সঠিকভাবে বুঝেছেন। তারা প্রকৃতপক্ষে উম্মতের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধি এবং তার মিটে যাওয়া সুন্নাতকে পুনরুজ্জীবিতকারী। তাদের দ্বারাই আল্লাহর কিতাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তারাও কিতাব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং কিতাবুল্লাহর ভাষায়ই কথা বলেছেন। সকল মুসলিম একথার ওপর নিশ্চিতভাবে একমত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা ওয়াজিব। তবে যদি তাদের কারো কাছ থেকে এমন কোনো কথা বর্ণিত হয়ে থাকে, যা সরাসরি সহীহ হাদীসের পরিপন্থী, তাহলে নিম্নের যে কোনো ওজরের ভিত্তিতে সে কথাটি পরিত্যাগ করা জরুরি।

ওযর সর্বমোট তিন প্রকার:

এক. উক্ত ইমামের এ বিশ্বাস না থাকা যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহীহ হাদীসে এমন বলেছেন।

দুই. তার এ বিশ্বাস থাকা যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে বক্তব্যের মাধ্যমে উক্ত মাসআলাই বুঝাতে চেয়েছেন।

তিন. তার এ বিশ্বাস যে, সহীহ হাদীসের হুকুমটি মানসূখ।

আমাদের ওপর তাদের বহু অনুগ্রহ রয়েছে। আমাদের পূর্বেই তারা ইসলামের এ নি‘আমতপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং আমাদের কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি প্রেরিত বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন ও তন্মধ্যে যা অস্পষ্ট ছিল তা স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন এবং তাদেরকে সন্তুষ্ট করুন।

﴿وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠﴾ [الحشر: ١٠]

“আর যারা তাদের পরে আগমন করেছে, তারা বলে: হে আমাদের রব! আমাদেরকে এবং আমাদের আগে আমাদের যে সব ভাইরা ঈমান এনেছে তাদেরকে ক্ষমা করুন। আর ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! আপনি দয়ালু, পরম করুণাময়।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ১০]

কোনো ইজতেহাদী ভুলের কারণে ওলামায়ে কেরামের সম্মানহানি করা বেদা‘আতীদেরই অনুসৃত পন্থা এবং মুসলিম উম্মাহর যারা শত্রু তাদেরই এক গভীর ষড়যন্ত্র- যাতে তারা ইসলাম ধর্মের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে, মুসলিমগণের পরস্পরের প্রতি শত্রুতা উৎপাদন করতে পারে এবং উম্মতের সালফে সালেহীন থেকে পরবর্তীদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে- যেরূপ বর্তমানে বিরাজ করছে। অতএব, কতিপয় প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্র যারা ফিকহ শাস্ত্রবিদ ও ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে, এ শাস্ত্রের পঠন-পাঠনে  অনুৎসাহিত করছে এবং এর হক ও সঠিক সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করছে- তাদের সতর্ক হওয়া উচিত। বরং তাদের উচিত নিজেদের এ ফিকহ নিয়ে গর্ববোধ করা এবং নিজেদের ওলামায়ে কেরামের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। আর ভ্রষ্ট ও উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রচার প্রোপাগাণ্ডা দ্বারা প্রতারিত ও প্রভাবিত না হওয়া। আল্লাহই তাওফীক দাতা।

[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৬৭৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৪০

[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৬৫১, ২৪২৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৩৫

[3] সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ২৬৪১

source.ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ

মন্তব্য করুন

Loading Facebook Comments ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button